ডিপ্রেশন
( Depression )
টেবিলের উপরে রাখা একটা গ্লাসের ভিতর কৌটা থেকে পিপড়া মারার সবটুকু পাউডার ঢেলে দিয়ে সেখানে কয়েক চামচ চিনি মিশিয়ে ভাল করে নাড়াচাড়া দিয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। বসে থেকে গ্লাসের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এটা এই প্রথম নয়, এই নিয়ে সপ্তম বার। প্রতিবারই কোনো না কোনো কারণে ব্যর্থ হয়েছি, কিন্তু এইবার আর নয়। অনেক হয়েছে। প্রথমবার যখন করতে চেয়েছিলাম তখন রুমের দরজা খোলা ছিল। সত্যি বলতে, দরজার ছিটকিনি নষ্ট। কোনোভাবেই সেটাকে লাগানো যায় না। প্রথমবার ঠিক সেরমকটাই হয়েছিল। গ্লাসের মধ্যে পিপড়ার ঔষধ ঢেলে সেখানে চিনি মিশিয়ে শরবত বানিয়ে ফেলেছিলাম। হুট করে কোত্থেকে যেন আম্মা চলে এলো আমার রুমে। বেস হয়ে গেল। পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছেন চেঁচামেচি করে। নিমিষেই বাড়িতে আত্মীয়স্বজন সবাই চলে এলো। সবাই গোল হয়ে বসে আমাকে তাদের মাঝে বসালো। তারপর শুরু হলো জিজ্ঞাসাবাদ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুনে মনে হচ্ছিল আমি দশ খুনের আসামী। আমার কিসের অভাব, কী চাই আমার, বিয়ে করব কিনা, কোথাও যাব কিনা, বিদেশ ঘুরতে যাব কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন। তাদের প্রশ্ন শুনে আমি যথারীতি অবাক। কিছু বলতে চেয়েও কারও জন্য কিছুই বলতে পারলাম না। সবাই খুব করে আমায় শাসিয়ে গেল, সাথে খানিকটা ভয়ও দেখিয়ে গেল। কিন্তু আজকের পর থেকে আমার থেকেও যে তাদের ভয়টা বেশি তা আমি তাদের চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। ওদের এত প্রেসার পেয়ে আমি চলে গেলাম ডিপ্রেশনে, কড়া ডিপ্রেশনে। যে কাজটা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি সে কাজটা সম্পূর্ণ করার তীব্র ইচ্ছা মনে চেপে বসল। আমি কখনো হারিনি, হারতে শিখিওনি। তারপর থেকে মাথায় শুধু একটাই ভাবনা, কাজটা আমাকে সম্পূর্ণ করতেই হবে, যেভাবেই হোক করতে হবে।
তারপরের পাঁচবার সেইম একই ঘটনা ঘটল আমার সাথে। সবকিছুই খুব সাবধানে করি কিন্তু প্রতিবার দরজাটা লাগাতেই কেবল ভুলে যাই। তারপরের পাঁচবার সেইম দরজা না লাগানোর জন্য বাসায় ধরা খেয়ে গেলাম। বাপ-মা কান্না করতে করতে শেষ। আমার সমস্যা কোথায়, কী চাই ইত্যাদি। সমস্যা একটাই, সবকিছু শুধু তারাই বলে যাচ্ছে কিন্তু আমাকে কিছুই বলার সুযোগ দিচ্ছেন না। আমি চলে গেলাম আরও ডিপ্রেশনে। ডিপ্রেশন আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগল। যে কাজটা করা কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র সে কাজটা করতেই আমি ছ'বার ব্যর্থ হয়েছি। এদিকে পড়ে গেলাম আরেক ঝামেলায়। তৃতীয়বার ঠিক একই কাজ করার পর বাবা একজন সিকিউরিটি গার্ড রাখলেন আমার জন্য। সিকিউরিটি গার্ড বলতে বডি গার্ড। শালা এত খচ্চর যে আমি বাথরুমে পটি করতে গেলেও শালা আমার সাথে সাথে যায়। বাথরুমে গিয়ে সে পিছন ফিরে তাকিয়ে থাকে আর আমি পটি করি। আরে ভাই, এভাবে কী শান্তিমত পটি করা যায়? বাথরুম হচ্ছে একটা রিলাক্সের জায়গা। ইউটিউব দেখতে দেখতে কিংবা গেম খেলতে খেলতে কাজ শেষ হয়ে যাবে কিন্তু শালা আমার সাথে বাথরুমের ভিতর অব্দি যাবে। তারপর মাঝেমধ্যে আবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে আমি আসলেই পটি করছি নাকি অন্যকিছু করছি। শালা এত মাইনকার চিপায় ফেলে দিছে যা বলার মত না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে শালার শরীরে হিসু করে দিতাম। তাও শালা যেত না। জীবনে এমন বডিগার্ড কখনো দেখিনি। ভাগ্যিস একটা ছেলের বডিগার্ড সে, কোনো মেয়ের বডিগার্ড হলে তো হয়েই ছিল!
সবকিছু ভাল করে সেট করে দিয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলাম। বাইরে থেকে কেউ ভিতরে ঢুকতে পারবে না। এবার আর কেউ আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না। একেবারেই পারবে না। আমি আজকে থেকে শান্তি, মুক্ত। আজকের পর থেকে কেউ আমাকে নিয়ে চিন্তাও করবে না আর আমিও আর ডিপ্রেশনে থাকব না। আজকের পরই ডিপ্রেশন শব্দটা থেকে একেবারে মুক্ত হয়ে যাব আমি। আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হবে না কাউকে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে শেষবারের মত একবার ফ্যামিলি ফটো দেখে নিলাম। আজকের পর থেকে কাউকে বিরক্ত করব না, কেউ আমাকে নিয়ে খামোখা চিন্তা করবে না। আমার মুখে বিজয়ের হাসি। আমি গ্লাসের সবটুকু পানি নিজের হাতে খাইয়ে দিলাম। পানিটা অনেক বেশি নিয়ে ফেলেছি। অর্ধেক পানি শুধু ভিতরে ঢুকেছে। বাকি অর্ধেক মুখ বেয়ে বেয়ে মেঝেতে পড়ে গেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় বসে পড়লাম। হঠাৎ করে কে যেন রুমের দরজাটা ভেঙে ফেলল। সবাই কান্না করতে করতে আমার কাছে চলে এলো। তারপর শুরু হয়ে গেল মরাকান্না। আমি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা চিৎকার দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিলাম।
"হুদ্দাই ভ্যা ভ্যা করতেছ কেন সবাই? আমি বিষ খাই নাই। আমি সাইন্সের ছাত্র। অনেক এক্সপেরিমেন্ট করতে হয় আমাকে। কৈ মাছের প্রাণ নাকি সহজে যায় না। তাই পিপড়া মারার ঔষধ খাইয়ে কৈ মাছের প্রাণ নেওয়া যায় কিনা সেটা এক্সপেরিমেন্ট করতেছিলাম। গত ছ'বার তোমরা আমাকে বাঁধা দিয়েছ এইটা করতে। বলার সুযোগটাই দাও নাই। আর আমি কোন দুঃখে মরতে যাব হ্যাঁ? আমার এত সুন্দর সুন্দর ৩ টা গার্লফ্রেন্ড থাকতে? পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে আমারে?"
কথা শেষ হবার পর সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। এতদিন তারা কী ভাবল আর আমি কী বলছি আজকে!
আম্মা পায়ের স্যান্ডেল খুলে হাতে নিলেন। তারপর জোরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, "কুত্তার বাচ্চা!"
আম্মার কথা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আব্বা, আম্মার দিকে আঁড়চোখে তাকালেন। আম্মা সেটা বুঝতে পেরে একটু নম্রভাবে আব্বাকে বললেন, "আরে তোমারে বলি নাই হিহি।"
আমি লুঙ্গিটা কাছা দিয়ে দাঁড়ালাম।
"কিরে লুঙ্গি এমন করলি ক্যান?"
"আম্মা, একটা ম্যাজিক দেখাই?"
আম্মা উৎসুকভাবে বললেন, "কই দেখি?"
আমি আমার দুই হাত উপরের দিকে তুলে বললাম, "এই যে এক হাত, এই যে এক হাত। কয় হাত হইলো?"
সবাই বলল, "দুই হাত।"
তারপর আমি বললাম, "ওই যে দেয়ালে দেখ আমার আরেক হাত।"
দাঁড়িয়ে থাকা সবাই দেয়ালের দিকে তাকাল। তারপর সামনে তাকাতেই দেখতে পেল আমি আর সেখানে নাই। পিছনে তাকিয়ে দেখে আমি দৌড়।
"আম্মা আমি গেলাম নানির বাড়ি।"
"কুত্তার বাচ্চা স্যরি ওমুকের বাচ্চা তুই বাইত আবি না কোনোদিন? তোরে কুত্তা পিডান পিডামু আমি। নাইলে আমি তোর বাপের বউ না!"
সমাপ্ত